জিবরাইল (আঃ) বা গ্যাব্রিয়েল (আশির্বাদ বর্ষিত হোক তার ওপর) ইসলামী বিশ্বাসে একজন প্রধান ফেরেশতা এবং কুরআন মাজীদ ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখিত একজন গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক সত্তা। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) কিভাবে বিভিন্ন নবীর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন ইসলামের পাশাপাশি খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মেও তার উল্লেখ আছে। তবে ইসলামিক ধর্মতত্ত্বে তাকে আল্লাহর কাছের ও প্রিয় ফেরেশতা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাদের মধ্যে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে জিবরাইলকে “রুহুল কুদুস” (পবিত্র আত্মা) এবং “রুহুল আমিন” (বিশ্বস্ত আত্মা) বলা হয়েছে।
নাম এবং অর্থ
জিবরাইল (আঃ) শব্দটি আরবি থেকে এসেছে এবং এর অর্থ হলো “আল্লাহর শক্তি” বা “আল্লাহর শক্তিধর।” ইসলামী শাস্ত্রে তাকে আল্লাহর আদেশ ও বার্তা বহনকারী ফেরেশতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ফেরেশতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান এবং আল্লাহর আদেশে সর্বদা কাজ করেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে ও ঐতিহ্যে তার উল্লেখ পাওয়া যায়, এবং তাকে গ্যাব্রিয়েল নামেও চেনা হয়।
কুরআনে জিবরাইল (আঃ) এর উল্লেখ
কুরআনে বিভিন্ন স্থানে জিবরাইলের (আঃ) উল্লেখ রয়েছে, যেখানে তাকে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে কুরআন অবতরণের সময় জিবরাইল (আঃ) নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছিলেন। কুরআনের সুরা বাকারা, আয়াত ৯৭-এ উল্লেখ করা হয়েছে:
“যে ব্যক্তি জিবরাইলের শত্রু, সে যেনো জেনে রাখে যে, আল্লাহ তাকে আপন ইচ্ছায় তোমার হৃদয়ে কুরআন নাযিল করেছেন।”
এছাড়াও সুরা তাকওয়িরের একটি আয়াতে বলা হয়েছে যে, “তাকে এক শক্তিশালী ফেরেশতার মাধ্যমে এই কিতাব নাযিল করা হয়েছে।” এ থেকেই বোঝা যায় যে, কুরআনের বাণী নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে জিবরাইলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ
মুহাম্মদ (সা.) যখন হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তখন প্রথমবারের মতো জিবরাইল (আঃ) তার কাছে আসেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম ওহি বা বার্তা পৌঁছে দেন। এই ঘটনার মাধ্যমেই নবী মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত প্রাপ্ত হন। প্রথম ওহির বাণী ছিল, “পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আলাক, আয়াত ১)
এই প্রথম ওহি অবতরণের সময় জিবরাইল (আঃ) নবী মুহাম্মদকে (সা.) আলিঙ্গন করেছিলেন এবং তাকে আল্লাহর আদেশে কুরআনের আয়াত পড়ার জন্য নির্দেশ দেন। প্রথমবারের সাক্ষাৎটি ছিল নবী (সা.)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত এবং এটিই ছিল নবুয়তের সূচনা।
মেরাজের রাতে জিবরাইলের ভূমিকা
মেরাজ বা ঊর্ধ্বগমন রাত ইসলামী ইতিহাসের একটি অসাধারণ ঘটনা, যেখানে নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ বিশেষভাবে আকাশে নিয়ে যান। এই যাত্রার অংশ হিসেবে জিবরাইল (আঃ) নবীর (সা.) সহচর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি নবীকে (সা.) বাইতুল মোকাদ্দাস থেকে সপ্তম আসমানের সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে যান। তবে সেখানে পৌঁছানোর পর জিবরাইল (আঃ) নবীকে (সা.) জানিয়ে দেন যে, তিনি আর সামনে যেতে পারবেন না, কারণ সেটি ছিল শুধু নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং আল্লাহর মধ্যে একান্ত সাক্ষাতের স্থান।
অন্য নবীদের সঙ্গে জিবরাইলের (আঃ) ভূমিকা
জিবরাইল (আঃ) শুধু নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্যই বার্তা নিয়ে আসেননি, বরং তিনি অতীতের অনেক নবী ও রাসূলের কাছেও আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন। ঈসা (আঃ)-এর জন্মের ঘটনায় জিবরাইলের (আঃ) উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি মরিয়মের (আঃ) কাছে এসে ঈসার (আঃ) জন্মের বার্তা দেন এবং আল্লাহর আদেশে তার কাছে এসে বলেন, “আমি শুধু তোমার প্রভুর দূত, আমি তোমাকে একটি পবিত্র সন্তান দিতে এসেছি।”
এছাড়াও নবী মূসা (আঃ) এবং হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে জিবরাইলের উপস্থিতি এবং ভূমিকা পাওয়া যায়। হাদিসে রয়েছে যে, জিবরাইল বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর আদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন এবং নবীদের সাহায্য করতেন।

জিবরাইলের (আঃ) শক্তি এবং ক্ষমতা
জিবরাইল (আঃ)-কে আল্লাহ এমন ক্ষমতা দিয়েছেন, যা সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে। তাকে অনেক আয়াতে “রুহুল কুদুস” বা পবিত্র আত্মা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সম্মানসূচক উপাধির মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তিনি একটি পবিত্র এবং নির্ভুল আত্মা, যিনি সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ পালন করেন। ইসলামের বিভিন্ন ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তিনি একটি মুহূর্তের মধ্যে আল্লাহর নিকট থেকে পৃথিবীতে এবং পৃথিবী থেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছতে সক্ষম।
কিয়ামতের দিনে জিবরাইলের (আঃ) ভূমিকা
ইসলামী বিশ্বাসে কিয়ামতের দিন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন, যেদিন আল্লাহ সমস্ত মানুষকে পুনরুত্থান করবেন এবং তাদের কাজের হিসাব নেবেন। হাদিসে বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদেশে সমস্ত ফেরেশতারা পুনরুত্থিত হবেন এবং তারা সেই দিনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন। জিবরাইলও (আঃ) এই দিনে উপস্থিত থাকবেন এবং আল্লাহর আদেশ পালন করবেন। কিয়ামতের দিনের ঘটনাগুলির মধ্যে তাকে কী ভূমিকা দেওয়া হবে, তা আল্লাহই জানেন।
ইসলামী ঐতিহ্যে জিবরাইলের মর্যাদা
ইসলামে জিবরাইল (আঃ) কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখা হয়। তাকে ফেরেশতাদের মধ্যে প্রধান হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাকে আল্লাহর আদেশ এবং নবীদের প্রতি তার বাণী পৌঁছে দেওয়ার কাজে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুসলিমরা তার প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা পোষণ করেন। ইসলামিক শিক্ষায় বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নির্দেশ পালন এবং নবীদের প্রতি আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে জিবরাইল (আঃ)-এর নিষ্ঠা ও অবিচলতা সব মুসলমানের জন্য আদর্শ।
উপসংহার
জিবরাইল (আঃ)-এর জীবনী এবং ভূমিকা ইসলামের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার মাধ্যমে আল্লাহর বাণী পৃথিবীর বিভিন্ন নবী ও রাসূলদের কাছে পৌঁছেছিল, যা মানুষের জন্য আল্লাহর আদেশ পালন ও জীবনযাপন সম্পর্কে জ্ঞান দেয়। তার নিষ্ঠা, একনিষ্ঠতা এবং আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্যের কারণে জিবরাইলকে (আঃ) ইসলামী বিশ্বাসে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। মুসলিমরা তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাকে আল্লাহর অনুগত এক বিশ্বস্ত দূত হিসেবে গ্রহণ করে।