একজন মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ কত?
একজন মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ কত?

একজন মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ কত? না জানলে জেনে নিন!

 একজন মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ কত?

মানুষের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য উপাদান হলো রক্ত। এটি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে। তবে, অনেকেই জানেন না যে একজন মানুষের শরীরে মোট কত রক্ত থাকে। এই প্রশ্নের উত্তর জানা আমাদের শরীর এবং তার কাজকর্ম সম্পর্কে আরো বিস্তারিত ধারণা দেয়।

তাহলে, একজন মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ কত? চলুন বিস্তারিত জানি।

 একজন মানুষের শরীরে মোট রক্তের পরিমাণ কত :

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে সাধারণত রক্তের পরিমাণ মোট শরীরের ওজনের ৭%-৮% এর মধ্যে থাকে। অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তির ওজন ৭০ কিলোগ্রাম হয়, তাহলে তার শরীরে প্রায় ৪.৯-৫.৬ লিটার রক্ত থাকতে পারে। এই পরিমাণ রক্ত শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এর অভাব হলে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটতে পারে।

শিশুর শরীরে রক্তের পরিমাণ:

শিশুদের ক্ষেত্রে, তাদের শরীরে রক্তের পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কম থাকে। নবজাতক শিশুর শরীরে রক্তের পরিমাণ প্রায় ২৫০-৩০০ মিলিলিটার হয়। তবে, বয়সের সাথে সাথে তাদের রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সাধারণত, দুই বছর বয়সে শিশুদের শরীরে ১ লিটার রক্ত থাকে।

রক্তের প্রধান উপাদানগুলো কী?

রক্ত মূলত চারটি প্রধান উপাদানে ভাগ করা যায়:

  • প্লাজমা: রক্তের প্রধান উপাদান হলো প্লাজমা, যা রক্তের প্রায় ৫৫% ভাগ থাকে। এটি জলীয় পদার্থ, প্রোটিন, হরমোন, খনিজ, গ্লুকোজ, এবং বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ ধারণ করে। প্লাজমা শরীরের কোষের মধ্যে পুষ্টি ও অক্সিজেন পরিবহন করে এবং বর্জ্য পদার্থ গুলি ফিল্টার করে বের করে দেয়।
  • রেড ব্লাড সেল (এ RBC বা লাল রক্তকণিকা): লাল রক্তকণিকা রক্তের প্রায় ৪৫% অংশ গঠন করে এবং এটি অক্সিজেন পরিবহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। লাল রক্তকণিকা শরীরের সব অংশে অক্সিজেন পৌঁছানোর কাজ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড শরীর থেকে বের করে।
  • হোয়াইট ব্লাড সেল (এ WBC বা সাদা রক্তকণিকা): সাদা রক্তকণিকা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি বিভিন্ন জীবাণু ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং শরীরকে সুরক্ষিত রাখে।
  • থ্রম্বোসাইট (এ Platelets বা রক্ত কণিকা): থ্রম্বোসাইট রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। এটি শরীরের ক্ষতস্থানে জমাট বাঁধার মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

রক্তের পরিমাণ কতটা কম বা বেশি হলে সমস্যা হতে পারে?

শরীরে রক্তের পরিমাণ অনেকটা কম বা বেশি হলে তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আসুন দেখি কিভাবে রক্তের পরিমাণ কম বা বেশি হলে কি সমস্যা হতে পারে।

রক্তের পরিমাণ কম হলে:

রক্তের পরিমাণ কম হওয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে হাইপোভোলেমিক শক বলা হয়। এটি সাধারণত তীব্র রক্তপাত বা দীর্ঘস্থায়ী রক্তসঞ্চালনের অভাবের কারণে ঘটে। রক্তের পরিমাণ কম হলে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না, যার ফলে:

  • শরীরে শক্তির অভাব: রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে শরীরের কোষে পর্যাপ্ত শক্তি পৌঁছাতে পারে না। ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা, এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
  • অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অকার্যক্ষমতা: হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, যা শরীরের সামগ্রিক কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করে।
  • শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস: রক্তের পরিমাণ কম হলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে, যা শীতলতা অনুভূতির সৃষ্টি করে।

রক্তের পরিমাণ বেশি হলে:

রক্তের পরিমাণ বেশি হওয়া একে পলিসিথেমিয়া বা হাইপারভোলেমিয়া বলা হয়, এবং এটি বেশিরভাগ সময় শরীরে অতিরিক্ত লবণ বা পানি জমে যাওয়ার কারণে ঘটে। এটি আমাদের শরীরের উপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং কিছু সমস্যা তৈরি করতে পারে:

  • হৃদযন্ত্রের উপর চাপ: অতিরিক্ত রক্ত হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে, ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • রক্তনালি ব্লক হওয়া: রক্তের পরিমাণ খুব বেশি হলে, রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা রক্তনালি ব্লক হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।
  • রক্তচাপ বৃদ্ধি: অতিরিক্ত রক্ত শরীরের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, যা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন তৈরি করতে পারে।

রক্তের পরিমাণ বজায় রাখার উপায়

শরীরের রক্তের পরিমাণ সঠিক পরিসরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এটি বজায় রাখতে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অনুসরণ করা যেতে পারে:

  • সুষম খাদ্যগ্রহণ: সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন, যাতে শরীরের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান মেলে। বিশেষ করে আয়রন, ভিটামিন বি ১২, এবং ফলিক অ্যাসিড যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করুন, কারণ এগুলো লাল রক্তকণিকা তৈরি করতে সাহায্য করে।
  • পর্যাপ্ত পানি পান: শরীরে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করুন। পানি রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়ক।
  • শারীরিক ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
  • অতিরিক্ত রক্তপাত এড়িয়ে চলুন: যেকোনো দুর্ঘটনায় বা অস্ত্রোপচারের পরে রক্তপাত হলে, তা দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিত। এছাড়া, শরীরে কোনো ধরনের গুরুতর আঘাত না হওয়ার জন্য সতর্ক থাকুন।

 উপসংহার

অতএব, একজন মানুষের শরীরে রক্তের পরিমাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর সঠিক মাত্রা শরীরের সুষ্ঠু কার্যক্রম বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয়।  রক্তের পরিমাণ কম বা বেশি হলে তা শরীরের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই, আমাদের উচিত সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি পান, এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখা। এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের সুস্থ রাখতে পারব এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে পারব।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *