ডায়াবেটিস এবং পায়ের যত্ন: কেন এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ?

ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন কীভাবে নেওয়া উচিত?

ডায়াবেটিস এবং পায়ের যত্ন: কেন এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ? আনিস আহমেদ নতুন একটি জোড়া জুতা কিনে অফিসে গেলেন, কিন্তু প্রথম দিনেই পায়ে ফোস্কা পড়ল। তিনি মনে করলেন, কয়েক দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু দিনগুলো অতিবাহিত হওয়ার পরেও ফোস্কা শুকায়নি, বরং বড় হয়ে গেছে। পরবর্তীতে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানলেন, এটি ডায়াবেটিসজনিত সমস্যা। ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের যত্ন নিয়ে বিশেষ সচেতনতা প্রয়োজন, কারণ অবহেলা করলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে।

ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়, এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পড়ে। এর মধ্যে পায়ের ওপর বিশেষ প্রভাব পড়তে পারে, যা নিয়ন্ত্রণে না রাখলে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

ডায়াবেটিস এবং পায়ের সমস্যা

ডায়াবেটিসের কারণে শরীরে স্নায়ু এবং রক্তনালীর ক্ষতি হতে পারে। পায়ের স্নায়ুগুলোর ক্ষতিতে পায়ের সংবেদনশীলতা কমে যায়, অর্থাৎ, আঘাত বা ক্ষত হলে রোগী বুঝতে পারেন না। একে নিউরোপ্যাথি বলা হয়, এবং এটি অনেক সময় ক্ষত বা ইনফেকশনকে গুরুতর আকারে পরিণত করতে পারে।

এছাড়া, ডায়াবেটিসের কারণে রক্ত সঞ্চালনও কমে যায়, যা পায়ের ক্ষত বা আলসারের শুকানোর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে ক্ষত থেকে গ্যাংগ্রিন পর্যন্ত হতে পারে, যার ফলে সার্জারি করেও পা কেটে ফেলতে হতে পারে।

ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের যত্ন কেন জরুরি?

ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে সংবেদনশীলতা কমে যায় এবং রক্ত সঞ্চালনও বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে, পায়ের ক্ষত বা আঘাত ছোট হলেও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়। গ্যাংগ্রিন বা অ্যামপুটেশন এর মতো মারাত্মক পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পায়ের যথাযথ যত্ন নেওয়া অপরিহার্য।

পায়ের যত্ন নেওয়ার প্রাথমিক নিয়মাবলী

ডায়াবেটিস এবং পায়ের যত্ন: কেন এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ?

ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের যত্ন নেওয়ার জন্য কিছু নিয়ম অনুসরণ করা প্রয়োজন:

  • প্রতিদিন পা পরীক্ষা করা: প্রতিদিন পায়ের তলা, আঙুল এবং অন্যান্য অংশ ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে। ক্ষত, ফোস্কা বা ফাটা অংশ দেখা গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
  • পা পরিষ্কার রাখা: প্রতিদিন কুসুম গরম পানি ও সাবান দিয়ে পা ধুয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর পায়ে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন, কিন্তু আঙুলের ফাঁকে যেন লোশন না থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে।
  • সঠিক জুতা পরিধান: সঠিক মাপের এবং আরামদায়ক জুতা পরিধান করা উচিত। খোলা বা হিলযুক্ত জুতা পরিধান করা থেকে বিরত থাকুন।
  • পায়ের নখের যত্ন: পায়ের নখ সাবধানে কেটে পরিষ্কার রাখতে হবে। নখ স্কয়ার (Square) আকৃতিতে কাটার চেষ্টা করুন, যাতে আঘাত বা ইনফেকশন এড়ানো যায়।
  • রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির জন্য ব্যায়াম: পায়ের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করতে সহজ ব্যায়াম যেমন পায়ের আঙ্গুল নড়ানো বা হাঁটাহাঁটি করুন।
  • ধূমপান পরিহার করা: ধূমপান রক্ত সঞ্চালনে বাধা সৃষ্টি করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়।

ডায়াবেটিসের কারণে পায়ে হতে পারে এসব জটিলতা

  • নিউরোপ্যাথি: দীর্ঘ সময় ধরে ডায়াবেটিস থাকার ফলে পায়ের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পায়ে অনুভূতির অভাব ঘটে। এর ফলে, রোগী আঘাত বা ক্ষত বুঝতে পারেন না এবং বিষয়টি অবহেলায় পরিণত হতে পারে।
  • রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা: ডায়াবেটিস রক্তনালীর ক্ষতি করতে পারে, যার ফলে রক্ত সঞ্চালন কমে যায় এবং ক্ষত শুকানোর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
  • ফোস্কা বা ক্ষত সংক্রমণ: ছোটখাটো ফোস্কা বা ক্ষতও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, যদি সময়মতো এর যত্ন না নেওয়া হয়।
  • গ্যাংগ্রিন: যদি ইনফেকশন বা ক্ষত নিয়ন্ত্রণে না আনা হয়, তবে এটি গ্যাংগ্রিনে পরিণত হতে পারে। গ্যাংগ্রিন হলো পায়ের টিস্যুর মৃত্যু, যা সার্জারি করেও পা কেটে ফেলা হতে পারে।

পায়ের যত্নে কিছু অতিরিক্ত সচেতনতা

  • পায়ের অস্বাভাবিকতা অবহেলা করবেন না: যদি পায়ে কোনো ক্ষত বা আঘাত দেখা দেয়, তা অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • গরম বা ঠান্ডা দিয়ে পা গরম করবেন না: ডায়াবেটিসের কারণে পায়ে সংবেদনশীলতা কম থাকে, ফলে গরম পানি বা হিটিং প্যাড দিয়ে পা গরম করলে অজ্ঞাতসারে পা পুড়ে যেতে পারে।
  • পায়ের যেকোনো সমস্যা হলে স্বতন্ত্রভাবে চিকিৎসা করবেন না: কোনো ধরনের পায়ে সমস্যা হলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওষুধ নেওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ডায়াবেটিস এবং পায়ের যত্নের পরিপূরক

ডায়াবেটিস রোগীদের শুধু পায়ের শারীরিক যত্নই নয়, তাদের জীবনের অন্যান্য শাখাতেও যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পায়ের যত্ন ছাড়াও, খাওয়া দাওয়া এবং শারীরিক সুস্থতাও দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিসের প্রভাবকে কমাতে সহায়তা করে।

 উপসংহার

ডায়াবেটিস রোগীরা পায়ের যত্নে যতটা গুরুত্ব দেবেন, ততটাই তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। সঠিক পায়ের যত্ন ও সতর্কতার মাধ্যমে গুরুতর ইনফেকশন, গ্যাংগ্রিন বা অ্যামপুটেশন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতা এবং সঠিক পায়ের যত্নের মাধ্যমে, রোগীরা একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হতে পারেন।

লিখেছেন: মাহমুদা আক্তার রোজী 

ফিজিওথেরাপি কনসালটেন্ট এবং জেরোন্টোলজিস্ট

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *