মাইগ্রেন একটি জটিল স্নায়বিক অবস্থা যা তীব্র মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, আলো ও শব্দের প্রতি সংবেদনশীলতা ইত্যাদি উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এটি বিশ্বের ষষ্ঠতম অক্ষমতা সৃষ্টিকারী রোগ। সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা থাকলে মাইগ্রেনের আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
🧠 মাইগ্রেন কী?
মাইগ্রেন হল এক ধরনের স্নায়বিক ব্যাধি, যা সাধারণত মাথার এক পাশে তীব্র, স্পন্দিত ব্যথার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, বমি, আলো ও শব্দের প্রতি অতিসংবেদনশীলতা ইত্যাদি উপসর্গ থাকতে পারে। মাইগ্রেনের আক্রমণ কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং এটি দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
🔍 মাইগ্রেনের কারণসমূহ
মাইগ্রেনের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো সম্পূর্ণভাবে জানা না গেলেও গবেষণায় দেখা গেছে, এটি মূলত মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র ও রক্তনালীর অস্বাভাবিক ক্রিয়া এবং নির্দিষ্ট উদ্দীপকের কারণে হয়ে থাকে। নিচে মাইগ্রেনের কিছু সম্ভাব্য কারণ ও ট্রিগার উল্লেখ করা হলো:
🧬 ১. জেনেটিক প্রভাব (Genetic Factors)
যদি পরিবারের কারো মাইগ্রেন থাকে, তবে আপনার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০% ক্ষেত্রে মাইগ্রেন বংশগত।
🔄 ২. হরমোন পরিবর্তন (Hormonal Changes)

বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে হরমোন পরিবর্তনের সময় মাইগ্রেন দেখা যায়, যেমন –
- মাসিকের সময়
- গর্ভাবস্থায়
- মেনোপজে
এস্ট্রোজেন হরমোনের ওঠানামা মাইগ্রেন ট্রিগার করতে পারে।
☕ ৩. নির্দিষ্ট খাবার ও পানীয়
কিছু খাবার ও পানীয় মাইগ্রেনের উদ্দীপক হতে পারে, যেমন:
- চকলেট
- চিজ
- ক্যাফেইন (চা, কফি)
- অ্যালকোহল
- মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (MSG)
- ফাস্ট ফুড বা প্রক্রিয়াজাত খাবার
🌞 ৪. পরিবেশগত প্রভাব
- উজ্জ্বল আলো
- উচ্চ শব্দ
- গরম বা ঠান্ডা আবহাওয়া
- তীব্র গন্ধ (পারফিউম, ধোঁয়া)
এই ধরনের পরিবেশ মাইগ্রেনের কারণ হতে পারে।
🧠 ৫. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ
- দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক উদ্বেগ
- হতাশা বা ক্লান্তি
এই ধরনের মানসিক অবস্থা মাইগ্রেনের অন্যতম ট্রিগার।
💤 ৬. ঘুমের ব্যাঘাত
- পর্যাপ্ত ঘুম না হলে
- অতিরিক্ত ঘুম
- অনিয়মিত ঘুমের রুটিন
ঘুম সংক্রান্ত সমস্যা মাইগ্রেন বাড়িয়ে দিতে পারে।
🔌 ৭. সেন্সরি উদ্দীপনা (Sensory Stimuli)
- তীব্র আলো ঝলকানি
- উচ্চ আওয়াজ
- স্ক্রিনের দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকা
এসব সেন্সরি উদ্দীপকও মাইগ্রেন সৃষ্টি করতে পারে।
🕰️ ৮. দৈনন্দিন রুটিনের পরিবর্তন
- খাবার না খাওয়া
- পানি কম খাওয়া
- অতিরিক্ত পরিশ্রম
রোজকার জীবনযাপনে হঠাৎ পরিবর্তন মাইগ্রেনের কারণ হতে পারে।
পরামর্শ: আপনার ব্যক্তিগত মাইগ্রেন ট্রিগার গুলো শনাক্ত করে তা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। মাইগ্রেন ডায়েরি রাখা এই কাজে সহায়ক হতে পারে।
🩺 মাইগ্রেনের লক্ষণসমূহ
মাইগ্রেন কেবল সাধারণ মাথাব্যথা নয়—এটি একটি জটিল নিউরোলজিক্যাল সমস্যা, যার সাথে শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। একেকজনের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিন্ন হলেও সাধারণভাবে মাইগ্রেন ৪টি ধাপে প্রকাশ পায়: প্রড্রোম (Prodrome), অরা (Aura), মাথাব্যথা (Headache), এবং পোস্টড্রোম (Postdrome)। নিচে প্রতিটি পর্যায়ের বিস্তারিত লক্ষণ তুলে ধরা হলো।
🕐 ১. প্রড্রোম (Prodrome) – মাইগ্রেন শুরুর আগে লক্ষণ
মাইগ্রেন শুরুর ১-২ দিন আগেই শরীর কিছু সংকেত দিতে শুরু করে। যেমন:
- ঘন ঘন হাই তোলা
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
- ঘুম ঘুম ভাব বা অবসাদ
- ঘাড়ে ব্যথা বা শক্ত হয়ে যাওয়া
- খাবারে বিশেষ রুচি (cravings), যেমন মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করা
- ঘন ঘন প্রস্রাব
🌈 ২. অরা (Aura) – কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়
সব মাইগ্রেন রোগীর অরা হয় না, তবে প্রায় ২৫%-এর ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়। সাধারণত মাইগ্রেন শুরু হওয়ার কিছু সময় আগে অরা হয় এবং এটি ২০-৬০ মিনিট স্থায়ী হয়।
দৃষ্টি সংক্রান্ত অরা:
- চোখে ঝলমলে আলো দেখা
- এক বা দুই চোখে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া
- জিগজ্যাগ দাগ বা রেখা দেখা
ইন্দ্রিয়জনিত অরা:
- শরীরের একপাশে অসাড়তা বা পিন-চোখ-চোখ অনুভব হওয়া
- কথা বলতে অসুবিধা হওয়া
- গন্ধ, শব্দ বা আলো বেশি তীব্র মনে হওয়া
🤕 ৩. মাথাব্যথা পর্যায় (Headache Stage)
এটি মাইগ্রেনের মূল পর্ব এবং সাধারণত ৪ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এর বৈশিষ্ট্য:
- এক পাশে তীব্র বা নাড়ানো ধরনের ব্যথা (throbbing or pulsating pain)
- ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়ে
- চোখের পেছনে বা কপালের পাশে ব্যথা শুরু হয়
- নড়াচড়ায় ব্যথা বেড়ে যায় (হাঁটা, ঝাঁকি, সিঁড়ি উঠা)
- বমি বমি ভাব বা বমি
- আলো, শব্দ, বা গন্ধে অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা (photophobia, phonophobia)
😴 ৪. পোস্টড্রোম (Postdrome) – ব্যথা শেষ হওয়ার পর
ব্যথা কমে যাওয়ার পরেও শরীর দুর্বল অনুভব করতে পারে। এই পর্যায়ে দেখা দিতে পারে:
- ক্লান্তি বা অবসাদ
- মুড সুইং
- মনোযোগে ঘাটতি
- হালকা মাথা ঘোরা
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
মাইগ্রেনের লক্ষণ শিশু, নারী, বা পুরুষ – সবার ক্ষেত্রেই একটু ভিন্ন হতে পারে। কারো ক্ষেত্রে এটি মাসে ২-৩ বার হয়, আবার কারো ক্ষেত্রে সপ্তাহে একাধিকবারও হতে পারে।
💊 মাইগ্রেনের চিকিৎসা

মাইগ্রেন চিকিৎসা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত:
১. তৎক্ষণিক ব্যথা উপশমের জন্য ওষুধ
২. প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা (Preventive Treatment)
এই দুটি পদ্ধতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যথা কমানো, ভবিষ্যতে মাইগ্রেনের তীব্রতা ও ঘনত্ব কমানো, এবং রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। নিচে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।
🔹 তৎক্ষণিক ব্যথা উপশম (Abortive or Acute Treatment)
এই ধরনের চিকিৎসা তখন ব্যবহার করা হয়, যখন মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। লক্ষ্য হচ্ছে ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা।
✅ সাধারণ ব্যথানাশক ওষুধ:
- Paracetamol: হালকা ব্যথার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ব্যবহারযোগ্য।
- NSAIDs (Non-Steroidal Anti-Inflammatory Drugs): যেমন Ibuprofen, Naproxen—মাঝারি ব্যথার ক্ষেত্রে কার্যকর।
✅ ট্রিপটানস (Triptans):
- মাইগ্রেনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ওষুধ, যেমন Sumatriptan, Rizatriptan, Zolmitriptan ইত্যাদি।
- যখন সাধারণ ব্যথানাশক কাজ করে না, তখন এটি ব্যবহার করা হয়।
✅ অ্যান্টি-এমেটিক্স (বমি কমানোর ওষুধ):
- Domperidone, Metoclopramide ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় বমি ও বমি ভাব কমাতে।
⛔ গুরুত্বপূর্ণ: ওষুধ নিজে না নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অতিরিক্ত ওষুধ ব্যবহার “Medication Overuse Headache” তৈরি করতে পারে।
🔹 প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা (Preventive Treatment)
যেসব রোগীর ক্ষেত্রে প্রতি মাসে ৪ বা তার বেশি মাইগ্রেন অ্যাটাক হয়, তাদের জন্য প্রতিরোধমূলক ওষুধ ও জীবনধারা পরিবর্তন অপরিহার্য।
✅ ওষুধের ধরন:
- Beta Blockers (যেমন Propranolol): রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, মাইগ্রেন কমায়।
- Calcium Channel Blockers (যেমন Flunarizine): রক্তনালী প্রশস্ত করে, মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখে।
- Anti-depressants (যেমন Amitriptyline): মস্তিষ্কে কেমিক্যাল ব্যালান্স করে মাইগ্রেন প্রতিরোধ করে।
- Anti-epileptics (যেমন Valproate, Topiramate): মস্তিষ্কের অতিরিক্ত উদ্দীপনা কমায়।
✅ নতুন থেরাপি (মার্কিন FDA অনুমোদিত):
- CGRP Inhibitors: Monoclonal antibody ইনজেকশন (যেমন Erenumab) যা মাইগ্রেন প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়।
🧘♀️ লাইফস্টাইল ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা
মাইগ্রেনের ওষুধের পাশাপাশি কিছু স্বাভাবিক অভ্যাসও খুব কার্যকর হতে পারে:
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ঘুমাতে যাওয়া ও ওঠা।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, ও শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যায়াম।
- রোজকার ডায়েরি রাখা: কোন খাবার বা পরিবেশে মাইগ্রেন হয় তা চিহ্নিত করতে।
- নিয়মিত খাবার খাওয়া: খালি পেটে থাকলে মাইগ্রেন বাড়তে পারে।
🌿 প্রাকৃতিক উপাদান ও সাপ্লিমেন্ট:
কিছু ভেষজ উপাদান বা ভিটামিন মাইগ্রেন প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। যেমন:
- Magnesium supplements
- Vitamin B2 (Riboflavin)
- Feverfew এবং Butterbur (উল্লেখযোগ্য ভেষজ)
⛔ এসব সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
🏥 কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
- মাসে ৪ বারের বেশি মাইগ্রেন হলে
- ওষুধ সত্ত্বেও ব্যথা কম না হলে
- হঠাৎ করে খুব তীব্র ও ভিন্ন রকমের মাথাব্যথা হলে
- চোখে অন্ধকার দেখা বা কথা বলায় সমস্যা হলে
🏠 ঘরোয়া প্রতিকার
মাইগ্রেনের ব্যথা অনেক সময় এতটাই তীব্র হয় যে ওষুধ ছাড়াও কিছু ঘরোয়া উপায় জানাটা জরুরি হয়ে পড়ে। নিচে কিছু কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার দেওয়া হলো, যেগুলো নিয়মিত চর্চা করলে মাইগ্রেনের কষ্ট কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব:
প্রথমত, আদা একটি অসাধারণ প্রাকৃতিক প্রতিকার। আদা মাইগ্রেনের বমি ভাব কমাতে সহায়তা করে এবং প্রদাহ হ্রাস করে। গরম পানিতে কাঁচা আদা সেদ্ধ করে সেই পানির চা পান করলে দ্রুত আরাম পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, পুদিনা পাতা মাথাব্যথা কমাতে দারুণ কার্যকর। পুদিনা পাতা বেটে তার রস কপালে লাগালে শীতল অনুভূতি তৈরি হয় এবং মাথার রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক হয়, ফলে ব্যথা কমে আসে।
তৃতীয়ত, বরফের প্যাক বা ঠান্ডা কাপড় কপালে দিয়ে রাখা যেতে পারে। এটি রক্তনালী সংকুচিত করে ব্যথা কিছুটা প্রশমিত করে।
চতুর্থত, পর্যাপ্ত পানি পান মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। ডিহাইড্রেশন মাইগ্রেনের অন্যতম কারণ হতে পারে, তাই দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
পঞ্চমত, একটি শান্ত ও অন্ধকার ঘরে বিশ্রাম নিন। অতিরিক্ত আলো, শব্দ বা গরম মাথাব্যথা বাড়াতে পারে। তাই নিঃশব্দ ও ঠান্ডা ঘরে শুয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলে ব্যথা কমে যেতে পারে।
এই ঘরোয়া প্রতিকারগুলো নিয়মিত ব্যবহার করলে ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা কমে এবং প্রাকৃতিক উপায়ে মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়
❓ সচরাচর জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন ১: মাইগ্রেন কি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য?
উত্তর: বর্তমানে মাইগ্রেনের স্থায়ী নিরাময় নেই, তবে সঠিক চিকিৎসা ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
প্রশ্ন ২: মাইগ্রেন কি বংশগত?
উত্তর: হ্যাঁ, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মাইগ্রেনের ইতিহাস থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রশ্ন ৩: মাইগ্রেনের জন্য কোন খাবার এড়ানো উচিত?
উত্তর: চকলেট, চিজ, ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, প্রক্রিয়াজাত খাবার ইত্যাদি এড়ানো উচিত।
প্রশ্ন ৪: মাইগ্রেনের সময় কী করা উচিত?
উত্তর: অন্ধকার ও শান্ত পরিবেশে বিশ্রাম নিন, ঠান্ডা সেঁক ব্যবহার করুন, প্রয়োজনে ওষুধ সেবন করুন।
প্রশ্ন ৫: মাইগ্রেন কি শিশুদেরও হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, শিশুদের মধ্যেও মাইগ্রেন দেখা যেতে পারে, তবে তাদের ক্ষেত্রে উপসর্গ ভিন্ন হতে পারে।