শিশুদের ইউরিন ইনফেকশন (UTI) বা প্রস্রাবের সংক্রমণ একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি শিশুর অস্বস্তি, জ্বর, পেটব্যথা, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে কিডনির সমস্যার কারণ হতে পারে। সঠিক সময়ের সঠিক পদক্ষেপই এই সমস্যা থেকে শিশুকে মুক্ত রাখতে পারে।
মেয়ে শিশুদের মধ্যে এই রোগের সংক্ৰমণ হওয়ার প্রবণতা বেশি কারণ মেয়েদের মূত্রনালী ছেলেদের মূত্রনালীর তুলনায় দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট। এছাড়া মেয়েদের মূত্রনালী পায়ুপথের খুব কাছাকাছি অবস্থিত, ফলে ব্যাকটেরিয়া পায়ুপথ থেকে মূত্রনালীতে খুব সহজে প্রবেশ করে প্রস্রাবের সংক্ৰমণ ঘটায়।
চলুন জেনে নেই এই সমস্যার কারণ, লক্ষণ এবং করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত।
ইউরিন ইনফেকশনের কারণ
নিশ্চয়ই। নিচে শিশুদের ইউরিন ইনফেকশনের কারণসমূহ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো, যাতে আপনি সহজেই বুঝতে পারেন কীভাবে এই সমস্যাটি তৈরি হয় এবং কোন অভ্যাস বা শারীরিক অবস্থা এর জন্য দায়ী হতে পারে।
১. ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ (Bacterial Infection)
শিশুদের ইউরিন ইনফেকশনের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, বিশেষ করে Escherichia coli (E. coli) নামের একটি ব্যাকটেরিয়া। এটি সাধারণত পায়ুপথে থাকে এবং পায়খানা করার সময় বা পরবর্তী পরিষ্কার না থাকলে ইউরেথ্রা হয়ে মূত্রথলিতে পৌঁছে সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। মেয়েশিশুদের ইউরেথ্রা ছোট হওয়ায় তাদের মধ্যে এই ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশের ঝুঁকি বেশি।
২. অপরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখা
শিশুর পায়খানা বা প্রস্রাবের পর সঠিকভাবে পরিষ্কার না করা, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে সামনে থেকে পিছনে না মুছলে জীবাণু ইউরিন প্যাথে চলে যেতে পারে। এ কারণে নিয়মিত ও সঠিকভাবে পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি।
৩. প্রস্রাব চেপে রাখা
অনেক শিশু প্রস্রাব চেপে রাখে বা সময়মতো টয়লেটে যেতে চায় না। এটি একটি বিপজ্জনক অভ্যাস, কারণ এতে মূত্রথলিতে জমে থাকা প্রস্রাবে ব্যাকটেরিয়া বেড়ে যায় এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।
৪. ভেজা ডায়াপার অনেকক্ষণ পরে রাখা
নবজাতক ও ছোট শিশুরা ডায়াপার ব্যবহার করে, কিন্তু যদি সেই ডায়াপার দীর্ঘ সময় ধরে না পরিবর্তন করা হয় তাহলে আর্দ্রতা ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে ইনফেকশন হতে পারে। ভেজা বা মলযুক্ত ডায়াপার শিশুর ত্বক এবং মূত্রপথে জীবাণুর বিস্তার ঘটায়।
৫. অপরিষ্কার ও আঁটসাঁট অন্তর্বাস
প্রতিদিন পরিষ্কার অন্তর্বাস ব্যবহার না করলে বা সঠিকভাবে না শুকিয়ে পরলে তাতে জীবাণু জন্মায়। আঁটসাঁট ও সিনথেটিক কাপড়ের অন্তর্বাস শিশুর ত্বক ঘেমে ফেলায় সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়ায়। তাই সুতির ও ঢিলা অন্তর্বাস শিশুর জন্য নিরাপদ।
৬. জন্মগত ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সমস্যা
কিছু শিশু জন্মগতভাবে ইউরিনারি সিস্টেমের কাঠামোগত সমস্যায় ভোগে। যেমন, Vesicoureteral Reflux (VUR) – এই অবস্থায় মূত্র মূত্রথলি থেকে কিডনির দিকে ফিরে যায়। এতে কিডনিতে ইনফেকশন হতে পারে এবং নিয়মিত ইউরিন ইনফেকশন দেখা দেয়।
৭. প্রচণ্ড গরম ও ঘাম
গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত ঘাম ও তাপের কারণে শিশুর শরীর আর্দ্র থাকে, যা ব্যাকটেরিয়ার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। ঘামে ভেজা শরীর বা প্রস্রাবের জায়গা নিয়মিত না মুছলে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।
৮. অপর্যাপ্ত পানি পান
যদি শিশু পর্যাপ্ত পানি না পান করে, তাহলে মূত্র ঘন হয়ে যায় এবং মূত্রনালিতে জমে থাকা জীবাণু সহজে ধুয়ে যায় না। এতে ব্যাকটেরিয়া বেড়ে গিয়ে ইনফেকশন সৃষ্টি করতে পারে। তাই শিশুকে পর্যাপ্ত তরল ও পানি খাওয়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৯. হরমোন বা ইমিউন সিস্টেমের দুর্বলতা
কিছু শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউন সিস্টেম) দুর্বল হলে সহজেই তারা যেকোনো ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ইউরিন ইনফেকশন অন্যতম। এমন শিশুদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হয়।
১০. নির্ধারিত সময়ের আগে টয়লেট ট্রেনিং
অনেক বাবা-মা শিশুকে খুব অল্প বয়সে টয়লেট ট্রেনিং দিতে চান, কিন্তু শিশু যদি ঠিকভাবে প্রস্রাব ধরে রাখতে না শেখে বা টয়লেট ব্যবহার করতে অস্বস্তি বোধ করে তাহলে তারা প্রস্রাব আটকে রাখে, যা ইউরিন ইনফেকশনের কারণ হতে পারে।
শিশুর ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ
🔶 ১. বারবার প্রস্রাব করার প্রয়োজন
শিশু অস্বাভাবিকভাবে ঘন ঘন প্রস্রাব করতে চাইলে, এটি ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে।
🔶 ২. প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া
যদি শিশুর প্রস্রাব করার সময় কাঁদে বা অস্বস্তি প্রকাশ করে, তবে এটি মূত্রনালিতে সংক্রমণের ইঙ্গিত দেয়।
🔶 ৩. প্রস্রাবের দুর্গন্ধ বা অস্বাভাবিক রঙ
ইউরিন যদি গন্ধযুক্ত, ঘন বা গাঢ় হলুদ রঙের হয়, তবে তা ইনফেকশনের লক্ষণ হতে পারে।
🔶 ৪. পেটের নিচের দিকে ব্যথা
শিশু যদি পেটের নিচে বা তলপেটে বারবার হাত দেয় বা চাপ খায়, তা ইনফেকশনের কারণে হতে পারে।
🔶 ৫. জ্বর (বিশেষ করে কোনো কারণ ছাড়াই)
ইউরিন ইনফেকশনের অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হলো হঠাৎ জ্বর হয়ে যাওয়া, যার পেছনে কোনো স্পষ্ট কারণ থাকে না।
🔶 ৬. খাওয়ার রুচি কমে যাওয়া
ইনফেকশন হলে শিশু সাধারণত খেতে চায় না, খাওয়ার প্রতি আগ্রহ কমে যায়।
🔶 ৭. বমি ভাব বা বমি
ইউরিন ইনফেকশন থেকে কিডনির দিকে ছড়িয়ে গেলে শিশুর বমি বা বমি ভাব দেখা দিতে পারে।
🔶 ৮. অতিরিক্ত কান্না ও অস্থিরতা
শিশু অস্বাভাবিকভাবে কান্নাকাটি করলে বা অস্থির আচরণ করলে তা অসুস্থতার ইঙ্গিত হতে পারে।
🔶 ৯. ওজন কমে যাওয়া (দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে)
অনেকদিন ধরে ইনফেকশন থাকলে শিশুর ওজন বাড়তে চায় না বা ওজন কমতে থাকে।
🔶 ১০. প্রস্রাবে রক্ত দেখা
মাঝেমধ্যে প্রস্রাবে সামান্য রক্ত দেখা দিতে পারে, যা ইউরিন ইনফেকশনের গুরুতর লক্ষণ।
এই লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি বা একাধিক লক্ষণ শিশুর মধ্যে দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
🩺 শিশুদের ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসা
শিশুর মূত্রনালিতে সংক্রমণ হলে দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা খুবই জরুরি। কারণ, অবহেলা করলে সংক্রমণ কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। নিচে ধাপে ধাপে এর চিকিৎসা পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।

✅ ১. ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সঠিক ডায়াগনোসিস করা
শিশুর প্রস্রাবের নমুনা সংগ্রহ করে Urine Routine Test ও Urine Culture Test করা হয়। এই পরীক্ষাগুলো সংক্রমণের ধরণ ও জীবাণুর প্রকার নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। এর ভিত্তিতেই সঠিক ওষুধ নির্ধারণ করা হয়।
✅ ২. অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা
ডায়াগনোসিস অনুযায়ী চিকিৎসক শিশুকে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করেন। সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন ওষুধ খেতে হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।
✅ ৩. প্রচুর পানি পান করানো
ইনফেকশন দূর করতে শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও তরল খাবার দিতে হবে। এতে প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ে এবং জীবাণু সহজে বের হয়ে যায়।
✅ ৪. জ্বর থাকলে উপযুক্ত ওষুধ দেওয়া
ইউরিন ইনফেকশনের কারণে জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় জ্বরের ওষুধ দেওয়া হয়। তবে ডোজ ও সময় অবশ্যই চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।
✅ ৫. ভালো পুষ্টি নিশ্চিত করা
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো খুব জরুরি। দুধ, ফল, শাকসবজি ও পর্যাপ্ত তরল খাবার রাখা উচিত।
✅ ৬. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
শিশুর পায়খানা ও প্রস্রাবের জায়গা সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ডায়াপার ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ডায়াপার নিয়মিত পরিবর্তন না করলে জীবাণু জমে ইনফেকশন হতে পারে।
✅ ৭. ফলো-আপ চিকিৎসা
প্রাথমিক চিকিৎসার পরে চিকিৎসক ফলো-আপ টেস্টের পরামর্শ দিতে পারেন। এতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সংক্রমণ পুরোপুরি নিরাময় হয়েছে কিনা।
✅ ৮. জটিল ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি
যদি সংক্রমণ খুব গুরুতর হয় বা শিশুর বয়স খুব কম হয় (বিশেষ করে ৩ মাসের নিচে), তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা চালানো হয়।
শিশুর ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধ
কিছু নিয়ম মেনে চললে ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনা যায়। যেমনঃ মেয়ে বাচ্চাদের টয়লেটে টিস্যু ব্যবহারের সময়ে সামনে থেকে পেছনে পরিষ্কার করুন। শিশুর যৌনাঙ্গ শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন। তাকে প্রচুর পানি পান করান। বাথটাব বা পুকুরে গোসল করার পরিবর্তে শাওয়ার কিংবা বালতির সাহায্যে গোসল করান।প্রস্রাব করার সময় শিশু যেন তাড়াহুড়া না করে সেদিকে খেয়াল করুন।
প্রস্রাবের বেগ আসলে তা ধরে রাখবে না এটা বাচ্চাদের শিখাতে হবে। টাইট প্যান্ট পরাবেন না। ইউরিন ইনফেকশন উপেক্ষা করলে সেটি খুব সহজেই গুরুতর রূপ ধারণ করতে পারে। তাই লক্ষণগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত ও ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।